পরিবারে মন দেবেন বলে টেনিস থেকে অবসর ঘোষণা করছেন সেরিনা। ছবি: রয়টার্স
নিজের কথা আগে।
তিরিশের কাছাকাছি এসে যখন সংসার পাতলাম, তখন সাংবাদিকতায় বেশ কয়েক বছর হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করি। দু’দিক সামলানোর জন্য যথেষ্ট দৌড়ঝাঁপ করতে হতই। জুড়েছে সংসার। সন্তান থাকলে কী ভাবে তার দেখাশোনা করব? চিন্তা হয়েছে। শেষমেশ পরিবারের চেয়ে কাজই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পরিবারে কম সময় দিয়েছি। এখনও সন্তান নেই।
অনেকেরই মনে হতে পারে, এ আবার কেমন কথা! কিন্তু এমনটা আরও মেয়ে ভাবেন। বাধ্য হন। কেউ মুখে বলেন, কেউ বলেন না।
টলিপাড়ায় অনেকেই বলেন, মিমি নিজের কাজকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন।
সেরিনার অবসর অবশ্য রূপকথা নয়। বরং তাঁর কাহিনি বলে, রূপকথার তারকাদের বাস্তব সাধারণের চেয়ে আলাদা হতে পারেনি। সেরিনা আরও কোটি কোটি পেশাদার মহিলার কথা বলেন। যেমন এক সহকর্মীর কাছে শুনেছিলাম তাঁর মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়ে মানসিক টানাপড়েনের কথা। বলেছিলেন, সন্তানকে দেখে আনন্দ হত। মাতৃত্বের অনুভূতি দারুণ লাগত। কিন্তু কাজের জায়গা ছেড়ে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকতেও অস্বস্তি হত। মনে হত, নিজের তৈরি করা কত কী হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে! কত কাজ নিজে করতে পারতেন, কিন্তু অন্যদের করতে দিতে হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছেন যেন।
আমার মায়ের কথাই ধরা যাক। দুই সন্তান। স্কুলে পড়াতেন। প্রিন্সিপাল পদে কাজ করেছেন। দু’দিকই তো সমান তালে সামলেছেন। কিন্তু মাকে কতটা দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে, তা দেখেছি। এ দায়িত্ব মেয়েদেরই নিতে হয়।
আলিয়া ভট্ট অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অভিনয় করবেন কি না, তা নিয়ে চর্চা হয় সে কারণেই। পরিস্থিতির পরিবর্তন যে হয়নি, তা বোঝার জন্য আবারও উদাহরণ তৈরি হল। সেরিনার বক্তব্য সেটা স্পষ্ট করে দিল। এক বার অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময়ে শারীরিক সমস্যা অনেক ভুগিয়েছে। আবারও তা তিনি চান না। তাই কাজ ছাড়বেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সফল নারীদের মধ্যে একজনকেও তাই ভাবতে হয়। তবে এত প্রগতির পরেও আসলে মহিলাদের নিজেদের সবটা হয় না? সময় তাঁদের হাতে নেই। মেয়েদের সময় তাঁদের নিজেদের নয়।
সেরিনা স্পষ্ট বলছেন, তিনি সেই মেয়েটিকে ‘মিস’ করবেন, যিনি এক কালে টেনিস খেলতেন। সেরিনা বলছেন বলে তবু সে কথা কানে বাজছে। আশপাশে কত মহিলা আছেন, যাঁরা মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়েছেন। কেউ বাদ দিয়েছেন কাজ, খেলা। সব। হয়তো বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পর্যন্ত পান না। সেরিনার মতো তারকাকেও সেই তাঁদের দলে পড়তে হয়।
সকলে অবশ্য বিষয়টি একই ভাবে দেখেন না। যেমন লেখক তিলোত্তমা মজুমদার মনে করেন, ছেলেদের আর মেয়েদের প্রাপ্তি ও ভাবে দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় না। ঠিক যেমন মাপা যায় না তাঁদের দায়িত্বও। তাঁর কথায়, ‘‘মা ও সন্তানের আলাদা যোগাযোগ থাকে। সেই প্রাপ্তি মায়েরই।’’ ফলে মাতৃত্ব একেবারেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। পেশাগত দায়িত্বকে কে কতটা প্রাধান্য দেবেন, তা তো তিনিই ঠিক করেন। তিলোত্তমার বক্তব্য, ‘‘পেশা ও ব্যক্তিগত জীবনে চাহিদার জায়গাগুলিতে তুলনা আদৌ হয় কি না, তা বলা কঠিন। আমি খালি একটি জিনিসেই বিশ্বাস করি না। তা হল কারও উপরে কিছু চাপিয়ে দেওয়া। অর্থনৈতিক ভাবে যে সব মেয়ে স্বাবলম্বী নন, তাঁদের এই সমস্যা আছে। অনেকের উপরেই পরিবারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যিনি স্বাবলম্বী, তাঁরা অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি কী ভাবে নিজের পরিবারের দেখভাল করবেন, তা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তার পক্ষে বা বিপক্ষে কারও মত দেওয়ার থাকে কি?’’
অর্থবানরা নানা ভাবে সন্তানলাভ করেন আজকাল। যেমন, সারোগেসি বেশ জনপ্রিয়। অর্থাৎ, নিজে গর্ভধারণ না করেও মা হচ্ছেন কেউ কেউ। নিজে গর্ভধারণ করেও অনেক মেয়ের আবার সে ভাবে নিতে হয় না দায়িত্ব। ‘ক্রাউন’ নামক ওয়েব সিরিজটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মনে থাকবে সে কথা। ইংল্যান্ডের রানির দায়িত্ব ছিল সন্তানের জন্ম দেওয়া। কিন্তু সন্তান বড় করার দায়িত্ব সামলেছেন পেশাদার লোকজন। রানি তখন ব্যস্ত থেকেছেন দেশ শাসনের কাজে। তবে কারও কারও বক্তব্য, পরিবারের যত্ন যথেষ্ট না হলে পরবর্তীকালে তাতে ভাঙনও ধরে। যেমন ওই সিরিজে রানির পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে।
বিজ্ঞানেও একটি কথা আছে। ‘এভলিউশন’। বিবর্তন। এতে মহিলাদের একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে। ডারউইন সাহেব অমূল মন্ত্র দিয়ে গিয়েছেন। যে কোনও প্রাণী একটি মাত্র মন্ত্রের দ্বারা চালিত। সচেতন ও অচেতন ভাবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল প্রাণের সংরক্ষণ করা। বেদবাক্য অভ্রান্ত না-ও হতে পারে। কিন্তু ডারউইনের এ বাক্য অভ্রান্ত। অন্তত এর বিরুদ্ধে কোনও যুক্তি কেউ দিতে পারেননি।
নারীরাই এই মন্ত্রের প্রধান পুরোহিত। জৈবিক ভাবে। সন্তানকে গর্ভে ধরা। তার জন্ম দেওয়া। তাকে পালন করা। এ সবের মধ্যে পুরুষদের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। এত কাল মহিলারা তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থের উপর সমষ্টিগত স্বার্থকেই জায়গা দিয়ে এসেছে। কেউ স্বেচ্ছায়। কেউ বাধ্য হয়ে। যেমন সীতাদের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। রামদের কোনও অপরাধ হয় না।
কিন্তু দিনকাল পাল্টেছে। শিক্ষা, প্রযুক্তির প্রসার মেয়েদের স্পর্শ করেছে। নারীপন্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা জীবনের অন্য ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত হবেন কেন? তাঁরা বলেন, পুরুষদের শাসিত সমাজে পুরুষরাই নিয়ম করেন। তার পর নারীদের তা মানতে বাধ্য করেন। ফলে মাতৃত্ব লাভের পথ বদলেছে। সারোগেসি এসেছে। দত্তক নেন অনেকে। এ ভাবে সমকামীরাও অভিভাবক হচ্ছেন। কর্ণ জোহর যেমন একাই দুই সন্তানকে বড় করছেন।
বিজ্ঞানই অন্তরায় ছিল। এখন বিজ্ঞান পথ দেখাচ্ছে। কর্ণর মতো প্রিয়ঙ্কা চোপড়াও সারোগেসির মাধ্যমে মা হয়েছেন। আগামীতে হয়তো আরও প্রচলিত হবে এই পথ। মেয়েদের জীবন কিছুটা হয়তো সহজ হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy