E-Paper

ইতিহাস আর রূপকথায় জড়িয়ে থাকা রেশম পথ

যে কাফেলা নিয়ে রওনা হবেন গৌতম, তাতেও আছেন হরেক কিসিমের চরিত্রেরা। আছেন মেজর হরি অহলুওয়ালিয়া, যিনি ১৯৬৫ সালে এভারেস্ট শীর্ষে চড়েছেন।

সুনন্দন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ ০৫:২৪
Share
Save

ইতিহাসও এক রংদার রেশম তন্তু। আরব্য রজনীর গল্পের মতো তারও এক গল্প থেকে অন্য গল্পে বয়ে চলা স্বভাব। গুটিপোকার গায়ের রোঁয়া জড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি সিল্ক, দুই কুঁজওয়ালা উটের পিঠে চেপে পুব থেকে পশ্চিমে রোম পর্যন্ত পাড়ি দেয় এক দীর্ঘ পথজালিকা ধরে। সে পথ বেয়ে ফিরে আসে কাচের বাসন, নতুন অস্ত্র, নতুন ধর্ম, নতুন রীতি। রেশম পথের ছোট্ট জনপদ থেকে উৎখাত হওয়া এক সৈনিক তাঁর আয়ুর শেষ চার বছরে চির কালের মতো বদলে দেবেন আধুনিক ভারতের চলার পথ।

চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ১৯৯৪ সালে এই পথে এক অভিযানে যাওয়ার দাওয়াত পেয়েছিলেন। ১৪,০০০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া হয়েছিল আট সপ্তাহে। মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে চিন ছুঁয়ে তিব্বত ঘুরে যাত্রা শেষ হয়েছিল নেপালে। এই পাড়ির গল্প নিয়ে তাঁর করা তথ্যচিত্র ‘হিমালয় ছাড়িয়ে’ (বিয়ন্ড দ্য হিমালয়াজ়)। তখনও চলচ্চিত্র বা স্থিরচিত্র, সবই তোলা হয় সেলুলয়েডে। খুব যত্নে রাখতে না পারলে এ সব ছবি বাঁচিয়ে রাখা খুব কঠিন। গৌতম যখন আবিষ্কার করলেন, তাঁর বহুমূল্য স্লাইডের সংগ্রহে ছাতা পড়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর ও বন্ধুদের মাথায় একটা ছবি-বই করার পরিকল্পনা আসে। তারই ফসল বইটি। ছবি-বই, তাই প্রায় একশো সত্তর পাতার বইয়ে শুধু পাতা-জোড়া ছবিই আছে সাতষট্টিটি।

আর আছে গল্পের অনুরণন। ইতিহাসের গল্প, ক্যারাভানসরাই আর চা-খানার গল্প, বিগত দুই শতাব্দীর অভিযাত্রী আর প্রত্নতত্ত্ববিদদের গল্প, মায়াবী হ্রদ আর তাকলামাকান মরুভূমিতে শুকিয়ে মমি হয়ে যাওয়া মানুষদের গল্প, গমগমে শহর আর নির্জন মেষপালকদের আস্তানার গল্প। গল্পে গল্পে পার হয়ে যাবে যোজন পথ।

বিয়ন্ড দ্য হিমালয়াজ়: জার্নিয়িং থ্রু দ্য সিল্ক রুট
গৌতম ঘোষ ও মাইকেল হাগিয়াগ
১২৫০ .০০
নিয়োগী বুকস

যে কাফেলা নিয়ে রওনা হবেন গৌতম, তাতেও আছেন হরেক কিসিমের চরিত্রেরা। আছেন মেজর হরি অহলুওয়ালিয়া, যিনি ১৯৬৫ সালে এভারেস্ট শীর্ষে চড়েছেন। পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার, কিন্তু তার অল্প দিন পরেই পাকিস্তান যুদ্ধে আহত হয়ে খুইয়েছেন স্বাভাবিক চলনশক্তি। কিন্তু তাঁর মন এবং লেখা রয়েছে সচল, আর তিনিই ফেঁদেছেন এই অভিযানের ছক। আছেন তাঁর এভারেস্ট জয়ের সঙ্গী রাওয়ত। আছেন মাইকেল হাগিয়াগ, যিনি গৌতমের ছবির প্রযোজক; আর এক বৌদ্ধ, যিনি ঘুরেফিরে চিনে নিচ্ছেন ভারত থেকে মধ্য এশিয়া আর চিনে বৌদ্ধধর্ম এসে পৌঁছনোর মানচিত্র; আছেন দোভাষী, গাড়ি চালক, চিত্রকুশলী, ভূতত্ত্ববিদ, লিয়াজোঁ অফিসারের এক মিশ্র দঙ্গল।

বাবরের আসা পথে হিন্দুকুশ পার হয়ে স্থলপথ ধরে ওঁরা রওনা হতে পারেননি। উড়ে যেতে হয়েছিল তাসখন্দে। প্রথম দু’টি গন্তব্য সমরকন্দ আর বুখারা। গৌতমের জিজ্ঞাসা, এখানকার চা-খানায় কী নিয়ে কথা বলে লোকে? তৈমুর কি এখনও খোঁড়া পায়ে বার হয় দিগ্বিজয়ে? হাফিজ়ের কথা কি বলে তারা? সোভিয়েট দেশ ভেঙে যাওয়ার গল্পও হয়? জানা যায়, সে তো হয়ই, আর হয় মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প।

অরেল স্টাইন আর লে ককের বৌদ্ধ শিল্পকলা আবিষ্কারের গল্প মাইকেলকে টানে। অহলুওয়ালিয়া হুইলচেয়ারে বসেও এই দীর্ঘ যাত্রার শেষে এক বার ফিরে দেখতে চান তাঁর জয় করা এভারেস্টকে, আর তিনি চান ১৯৬২ সালের তিক্ততা মুছে ফেলে দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যে মৈত্রী আর সৌহার্দ্য স্থাপনের এক যাত্রা।

মধ্য এশিয়ার ঝলমলে সব শহর পেরিয়ে, উষ্ণ হ্রদ পেরিয়ে, তাকলামাকান মরু পেরিয়ে, দুঃসাহসী বাঁক নিয়ে কাফেলা পৌঁছে যাবে একদা নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতে— লাল ফৌজের প্রবেশ আর দলাই লামার প্রস্থানের চল্লিশ বছর পরেও লোককথার তিব্বত যেখানে টিকে আছে চমৎকার। পৃথিবীর ছাদে হাওয়া পাতলা। এবং দীর্ঘ পথের ধকল মেজর অহলুওয়ালিয়ার স্বপ্নকে পুরো হতে দেবে না। কিন্তু যে নর্থ বেসক্যাম্পের রাস্তা ধরে এক সময় শুরু হত এভারেস্ট অভিযান, যেখান থেকে তাঁর এভারেস্টকে প্রায় স্পর্শ করে হারিয়ে গিয়েছিলেন ম্যালোরি, সেখান থেকে এই উচ্চতম শিখরকে প্রত্যক্ষ করবেন গৌতম আর তাঁর জিপের সহযাত্রীরা। তার পর যে পথ দিয়ে ইয়ংহাজ়ব্যান্ড তিব্বত অভিযানে গিয়েছিলেন, সেই রাস্তা ধরে ফিরে আসবে ক্যারাভ্যান।

গৌতম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ ভাবে ছবি করা ছিল তাঁর কাছে নতুন। এক একটা জায়গায় অনেক দিন থাকা বা ছবি করার জন্য দরকারি লোক-লস্কর যথেষ্ট ছিল না। এমনকি, আগে থেকে করা কোনও চিত্রনাট্য ছিল না। দু’টি ইউনিট আলাদা আলাদা ভাবে ছবি তুলত, যাতে অল্প সময়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যায়। ফিরে আসার পরে তাঁর মনে হয়, পুরো অঞ্চলটি ইতিহাস-সম্পৃক্ত। এখানকার যোদ্ধা, সুফি সাধক, কবি, বৌদ্ধ সংস্কৃতির আগমন— এ সব গল্প দিয়েই গেঁথে তুলতে হবে এই তথ্যচিত্রের ধারাভাষ্য। ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম, দিল্লি আর কলকাতার জাদুঘর, এবং অবশ্যই এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগার তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। গৌতম প্রথমেই বলে নিয়েছেন যে, এই ধারাভাষ্যটিই হল এই বইটির লেখ্য অংশটুকুর সিংহ ভাগ। পাঠকদের কাছে এই ভাষ্যটি ইতিহাসের এক সহজ পাঠ। রোমাঞ্চকর এক পথ পরিক্রমাও বটে।

এ রকম বইয়ের প্রধান আকর্ষণ না দেখা মোহময় নামের সব শহর আর নিসর্গের দুর্দান্ত সব ছবি। দেখতে পাওয়া যাবে তৈমুরের সমাধিসৌধ আর বিখ্যাত সব প্রাসাদ, গুম্ফা, দুর্গ ও বাজার। দেখা যাবে মরুভূমি চিরে রাস্তার বিস্তার, তিব্বতকে দেখা যাবে তার মলিনতায় আর জৌলুসে। আর দেখা যাবে ছত্রিশ জাতের মেয়ে, মরদ আর বাচ্চার মুখ। পুনরুদ্ধার করা ছবিগুলি একটু ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে।

সত্যজিৎ রায় আমাদের অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছেন শুটিংয়ের গল্প লিখে। গৌতম এত দিনের গল্পে একটিও নাগরা লুকোনোর গল্প বলেননি, শিবির পাততে গিয়ে কোনও হাস্যকর বিপর্যয় হয়েছিল কি না বলেননি, এক কুচি ‘ভিতর’-এর গল্পও ফাঁস করেননি। অনুরোধ রইল, করেন যেন কোনও দিন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Book Review Silk Route

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

SAVE 29%*
এক বছরে

১১৯৯

১১৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

১৪৯

১২৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।