১৬ জুন ২০২৫
Mountaineering

বাঙালি বেড়াতে পছন্দ করে, পাহাড়ে যাওয়ার টান যথেষ্ট, কিন্তু পর্বতারোহণে উৎসাহ আগে দেখা যায়নি

পর্বত অভিযান এমনটি আগে ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ যদিও হিমালয়ের পাদদেশে। এবং বাঙালিরা সব সময়ে ভ্রমণপিপাসু। তা সত্ত্বেও পর্বত অভিযান বাঙালিদের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। আসলে এর কারণটি একটু অন্য রকম।

Anindya Jana

পশ্চিমবঙ্গ যদিও হিমালয়ের পাদদেশে, তা সত্ত্বেও পর্বত অভিযান বাঙালিদের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। ছবি : লিউক হেলগেসন।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৫১
Share: Save:

অভিযাত্রী দলের সদস্যরা ছিলেন অবিবাহিত। কেউ শিক্ষক। কেউ বা কেরানি। কেউ দোকানি। কিন্তু চেহারায়, সহযাত্রী সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন, সকলেই বাঙালি।

২০,৭০০ ফুট উঁচু নন্দাঘুণ্টি অভিযান তখন ছিল এক বিস্ময়কর প্রয়াস। এভারেস্ট স্বপ্নেরও বাইরে। আজ ২০ জনেরও বেশি বাঙালি এভারেস্ট ছুঁয়েছেন। এক জন আবার পৌঁছে গিয়েছেন অক্সিজেন ছাড়া।

এমনটি আগে ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ যদিও হিমালয়ের পাদদেশে। এবং বাঙালিরা সব সময়ে ভ্রমণপিপাসু। তা সত্ত্বেও পর্বত অভিযান বাঙালিদের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি।

আসলে এর কারণটি একটু অন্য রকম

দিল্লির অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং পর্বত উৎসুক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গোটা বিশ্বে কোথাওই পর্বতারোহণ খুব জনপ্রিয় খেলা নয়। বলেন, ‘‘দুন স্কুলে দুই পর্বতারোহী শিক্ষক ছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে হোল্ডসওয়ার্থের কথা বলতে হয়। তাঁর উৎসাহে ছাত্রেরাও কেউ কেউ মাউন্টেনিয়ারিং শেখার দিকে ঝোঁকে। কিন্তু অন্যান্য নামী স্কুলে কাউকে সে ভাবে পর্বতারোহণে মন দিতে দেখা যায়নি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তেমন ছিল না।’’ রুদ্রাংশুবাবুর মতে, পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ট্রেকিং করার ইচ্ছা আলাদা। সেটি তো বেড়ানো। কিন্তু শৃঙ্গজয়ের জন্য যথেষ্ট কঠিন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তা পাওয়াও সহজ নয়। সে কারণেই হয়তো সাধারণ বাঙালির জীবনের অঙ্গ ছিল না পর্বতারোহণ। তাঁর কথায়, একটি সময় পর্যন্ত বাঙালিদের পাহাড়ে যাওয়া মানে ছিল তীর্থ। মূলত কেদার-বদ্রী যাওয়া।

৬০ বছরে অবশ্য বাংলায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। বাঙালির আগ্রহেও বৈচিত্র এসেছে। পর্বত অভিযান তার একটি মাত্র। রুদ্রাংশুবাবুর কথায়, ‘‘এটি একেবারেই হালের প্রবণতা। কিছু কাল আগেও এত বাঙালি পর্বতারোহী দেখা যেত না।’’

শৃঙ্গজয়ের জন্য যথেষ্ট কঠিন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন

বসন্ত-দেবাশিসের কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়।

বসন্ত-দেবাশিসের কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়।

আশ্চর্যের বিষয় হল, যে সব জেলায় একটি ঢিবি পর্যন্ত নেই, সেখানেও পর্বতারোহণের চল বেড়েছে। একটি সময়ের পর থেকে বাংলার কোণে কোণে পর্বতারোহীদের ক্লাব খুলতে শুরু করে। সে সব ক্লাব এখনও আছে। হাওড়া থেকে কৃষ্ণনগর, সর্বত্র। ২০১০ সালে বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস এভারেস্টে পা রাখার পর থেকে কৃষ্ণনগর ক্লাবের নাম বেশি ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে তিন বছরে পর পর তিনটি সামিট হয়। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা।

‘দেশ’ পত্রিকায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সান্দাকফু ভ্রমণের গল্প পড়ে কৃষ্ণনগরের এক ভ্রমণপ্রেমী বাঙালি অশোক রায়ের ইচ্ছা হয়, তিনিও সেই পাহাড়ে যাবেন। সাধারণত বাঙালি একটি লেখা পড়লে আরও একটি লেখার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু কৃষ্ণনগর আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানেই। সেখানকার অশোকবাবু অন্যদের থেকে জামা-জুতো ধার করে, পিঠে সে সব বেঁধে বেরিয়ে পড়েন পাহাড়ে চড়তে। ‌আশির দশকে বাঙালির রোমান্স কিন্তু পাহাড়ে চড়া ছিল না। সিপিএম-নকশাল ঘিরে রোমান্টিকতা অনেক দেখা গিয়েছে। কবিতা লেখাও ছিল। সান্দাকফু যাত্রা থেকে কৃষ্ণনগরের অন্য রোমান্টিকতা শুরু।

অশোকবাবু এর পর ঠিক করেন, একটি মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব তৈরি করবেন। ১৯৮৬-তে ক্লাব তৈরি হল। পরের বছর সেখানেই যোগ দিলেন ব্যাঙ্ককর্মী বসন্তবাবু। তার কয়েক বছরের মধ্যে এলেন কলেজপড়ুয়া দেবাশিসবাবু। বসন্ত সান্দাকফু-ফালুট গেলেন। দেবাশিস ঘুরে এলেন জোংরি। অন্য সদস্যরাও একটু একটু করে এক-এক দিকে। সেই ক্লাবে তত দিনে বাৎসরিক রক ক্লাইম্বিং কোর্স চালু হয়েছে। অশোকবাবু গেলেন পহেলগামে মাউন্টেনিয়ারিংয়ের কোর্স করতে। তার থেকে লাভ হবে সকলেরই। বসন্তবাবু আর দেবাশিসবাবুও গেলেন শিখতে। তবে উত্তরকাশীর ‘নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং’-এ। এর বেশ কিছু বছর পর তৈরি হল তাঁদের জুটি। ১৯৯৬ সালে গঢ়বালের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কামেট (৭,৭৫৫ মিটার) পাড়ি দিলেন বসন্ত-দেবাশিস। তার পর থেকে আর থামেননি। যেমন সুযোগ পেয়েছেন, নিজেদের মতো করে এগিয়ে গিয়েছেন। ২০১০ সালে সেই জুটিই বাংলার প্রথম এভারেস্টজয়ী হয়ে ফেরে।

এই আকাঙ্ক্ষার গল্পের শিকড় আরও গভীরে

একই ক্লাব থেকে। সেই ১৯৬০-এর নন্দাঘুণ্টি অভিযানের পর আবারও যেন পর্বতারোহণের সার্কিটে নবজাগরণ ঘটে বাংলায়। ২০১৬ সালে এভারেস্ট জয়ী দেবরাজ দত্ত বলেন, ‘‘আসলে বাংলার শিল্পাঞ্চলগুলিতেই মূলত বাড়তে পেরেছে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলি। এই খেলায় অনেকটা টাকা লাগে। শিল্পাঞ্চলে তবু তার জোগান হয় । হাওড়া, ব্যারাকপুর, কৃষ্ণনগর, আসানসোল, কলকাতায়। যেখানে অর্থসাহায্য দেওয়ার মতো কিছু মানুষ রয়েছেন, সেখানেই।’’ সেই কিছু মানুষের উৎসাহ পেয়ে এক দল লড়ে চলেছেন নতুন কিছু করার তাগিদে। বাজি রাখছেন নিজেদের সবটুকু। জীবনও।

  • বাঙালির প্রথম নন্দাঘুণ্টি অভিযান সম্ভব হয়েছিল আনন্দবাজার সংস্থার অর্থানুকূল্যে। এখন বিভিন্ন জেলার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা টাকা ধার করে পাহাড়ে ওঠেন। সফলও হন।
  • ছন্দা গায়েন, টুসি দাসের মতো এভারেস্ট জয়ীরাও রয়েছেন সেই তালিকায়।
  • বিনা অক্সিজেনে এ বছর এভারেস্টে উঠলেন পিয়ালি বসাক। এমন কীর্তি বাঙালির এই প্রথম। তিনিও কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে গিয়েছেন।

দেবরাজ, পিয়ালি কিংবা দেবাশিস, সকলে একটি কথা বলে থাকেন, পাহাড়ের শিখরে পৌঁছনোর আনন্দই আলাদা। মনে হয়, সব শ্রমের পর তৃপ্তি। নন্দাঘুণ্টি অভিযানের কথা লিখতে গিয়েও সে কথা উল্লেখ করেছেন গৌরকিশোরবাবু। শৃঙ্গজয় করার ক্লান্তি সত্ত্বেও সেই সন্ধ্যা কেটেছিল হইচই করে। নাচ-গানও হয়েছিল। শিখরে ওঠার আনন্দ এমনই।

বিনা অক্সিজেনে এভারেস্ট জয় করা মহিলা এ দেশে পিয়ালিই প্রথম।

বিনা অক্সিজেনে এভারেস্ট জয় করা মহিলা এ দেশে পিয়ালিই প্রথম।

বিনা অক্সিজেনে এভারেস্ট জয় করা মহিলা এ দেশে পিয়ালিই প্রথম। সে খ্যাতি পাওয়ার পর তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারির গল্পের কথা মনে পড়ছে তাঁর। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলায় নোরগে আর হিলারির এভারেস্ট জয়ের গল্প পড়েছিলাম। সেই থেকেই পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছা হয়।’’ এখন সেই তালিকায় রয়েছে তাঁর নামও। তবে আলাদা করে ইতিহাস গড়েছেন। অক্সিজেন ছাড়া গিয়েছেন। এমন আরও ইতিহাস তৈরি করতে চান। কিন্তু অর্থের দিকটি ভাবায়। এভারেস্ট জয়ের পর যদি অর্থসাহায্য বেশি পান, সে কথাই বার বার মনে হচ্ছে তাঁর। তবে আরও কিছু স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব হলেও হতে পারে।

দিল্লির অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং পর্বত উৎসুক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গোটা বিশ্বে কোথাওই পর্বতারোহণ খুব জনপ্রিয় খেলা নয়। বলেন, ‘‘দুন স্কুলে দুই পর্বতারোহী শিক্ষক ছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে হোল্ডসওয়ার্থের কথা বলতে হয়। তাঁর উৎসাহে ছাত্রেরাও কেউ কেউ মাউন্টেনিয়ারিং শেখার দিকে ঝোঁকে। কিন্তু অন্যান্য নামী স্কুলে কাউকে সে ভাবে পর্বতারোহণে মন দিতে দেখা যায়নি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তেমন ছিল না।’’ রুদ্রাংশুবাবুর মতে, পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ট্রেকিং করার ইচ্ছা আলাদা। সেটি তো বেড়ানো। কিন্তু শৃঙ্গজয়ের জন্য যথেষ্ট কঠিন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তা পাওয়াও সহজ নয়।সে কারণেই হয়তো সাধারণ বাঙালির জীবনের অঙ্গ ছিল না পর্বতারোহণ। তাঁর কথায়, একটি সময় পর্যন্ত বাঙালিদের পাহাড়ে যাওয়া মানে ছিল তীর্থ। মূলত কেদার-বদ্রী যাওয়া।

মনে কি সত্যিই রাখেন না? তবে পিয়ালিরা জন্মান কী ভাবে? এক ছন্দা নিখোঁজ হলে আর এক পিয়ালির দেখা মিলত কি, কেউ কিছু মনে না রাখলে? উত্তর দিয়ে দেন পিয়ালিই। বলেন, ‘‘ছোটবেলায় পাহাড়ের গল্পের পাশাপাশি আরও কিছু গল্প পড়েছি। অধিকাংশই বিখ্যাতদের জীবনী। তাঁরাও তো কষ্ট করে, প্রায় সব খুইয়ে নিজেদের কাজ করেছেন। তাঁদের সকলে মনে রেখেছেন।’’ পিয়ালিদেরও তেমন হতে ইচ্ছা হয়।

দেবাশিসের মনে হয়, স্বপ্নপূরণের জন্য হঠকারিতা না করাই ভাল। ধীরে ধীরে এগোতে হয়। আট হাজার মিটারের শৃঙ্গে যাওয়ার আগে যদি বেশ কয়েক বার ছ’হাজার, সাত হাজারের শৃঙ্গ অভিযানে যাওয়া যায়, তবে দুর্ঘটনা কম ঘটে। উত্তর পাওয়া যায় গৌরকিশোর ঘোষের ‘নন্দাকান্ত নন্দাঘুণ্টি’-তে। দেশের প্রথম অভিযান অযোধ্যা পাহাড়ে হয়নি। হয়েছিল সোজা ৬,৩০০ মিটারে। কৃষ্ণনগরে কোনও ঢিবি না থাকা সত্ত্বেও প্রথম অভিযানে অশোকবাবু চলে গিয়েছিলেন সান্দাকফু। তা-ও তো ৩,৬০০ মিটার উঁচু!

অর্থাৎ, মরা মরা করতে করতেই বাঙালি শেষ পর্যন্ত রাম বলতে শিখেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Follow us on

Download the latest Anandabazar app

Websites

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy