পুজো মানে সেপ্টেম্বর নয়, অক্টোবর । কিন্তু তার চাঁদা তোলার তোড়জোড় শুরু হত আমাদের স্বাধীনতা দিবসের পর থেকে। মিনিমাম-চাঁদা কত টাকা হবে, কাদের কাছ থেকে বেশি চাঁদা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, কারা চাঁদা দিতে গিয়ে নানারকম ফ্যাচাং করে আর তাদের কাছে কাদের চাঁদা নিতে পাঠানো হবে— এই সব নিয়ে তুলকালাম আলোচনা হত। চাঁদা তোলার জন্য ছোট-ছোট কতকগুলো দল তৈরি হত, তারা বিভিন্ন পাড়ায় চাঁদা তুলতে বেরোত। চাঁদা তুলতে তুলতে ওই দলটার এমন হয়ে গিয়েছিল যে, পাড়ায় আসা কোনও অল্প-চেনা লোকের নাম বললেও ওরা ঠিক তার ঠিকানা বাতলে দিত।
প্রতিটি চাঁদা-তোলার দলে এক জন করে সিনিয়র জেঠু থাকতেন। থাকতেন জনা দুই কাকু, তিন-চার জন দাদা আর আমাদের মতো দু’-তিন জন চ্যাংকাগোছের ছেলে। আমাদের পারমিশন ছিল রোববার সকালবেলায় ওদের সঙ্গে বেরোনোর। সন্ধেবেলায় ওরা আমাদের নিতে চাইত না। ‘কী রে, পড়াশোনা নেই? বাড়িতে কী বলে বেরোলি ?’ এমন নানা প্রশ্ন করে আমাদের না-নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। মাঝে মাঝে যাতে সঙ্গে নিয়ে যায়, সে জন্যে ওদের মন রেখে চলতে হত। হয়তো পাড়ায় ক্রিকেট খেলা চলছে। আমি ব্যাট করছি। ওদের কেউ এসে একটু ব্যাট করতে চাইলেই নিজের ব্যাটটা এমন ভাবে এগিয়ে দিতাম যেন ব্যাটটা ওরই। হাতের আমচুর বা আলুকাবলি ওদের যে-কারোর দিকে তখন এমন আকুতি নিয়ে বাড়িয়ে ধরতাম, যেন আমি ধন্য।
তখন আমরা সদ্য এইট-নাইন। মনটা সবে একটু উড়ু-উড়ু করছে। পাড়ার সমবয়সী কিশোরী, যারা মা-বাবার হাত না-ধরে স্কুলে বেরোয় না, ছোটকাকার পাঞ্জাবির খুঁট আঁকড়ে না-ধরে পাড়ার মিষ্টির দোকানে টকদই কিনতে যায় না— তাদেরই বাড়ির কড়া নেড়ে, বেল বাজিয়ে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় তারাই দরজা খুলে দিচ্ছে। সদর-দরজা বা বাড়ির দালানের মোটাসোটা থামের আড়ালে তাদের উঁকিঝুকি মারতে দেখছি। তেষ্টার অজুহাতে চাঁদা-তোলা-দাদারা জল খেতে চাইলে বেশির ভাগ সময় এদেরই উচ্চমাধ্যমিক দিদিরা কাঁসার গেলাসে করে জল এনে দিচ্ছে। আর জলটা যদি তাদের মা নিয়ে আসতেন তবে কপাল ভাল থাকলে একখানা করে বাড়িতে বানানো অতি উপাদেয় নারকেল নাড়ু বা নারকেলের তক্তি জুটে যেত। আর দাদারা, সেই জলটা ঢকঢক করে খেয়ে হাসিহাসি মুখে, ‘জলটা মাটির কুঁজোর, না!’ জিগ্যেস করার একটা দারুণ সুযোগ পেয়ে যেত।

আমরা ওই সব বাড়িতে যাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইতাম, তাদের সঙ্গে হঠাৎই হয়তো কথা বলার সুযোগ জুটে যেত পুজোর ঠিক আগের কোনও বিকেলবেলায়, শেষ মুহূর্তে বাকি থাকা চাঁদার লিস্টি আমাদের মতো দু-চার জন মিলে ঝালাই করতে বেরিয়ে, ‘কাকু আছেন?’ ‘না তো...বাবা তো এখন আপিসে।’ ‘ও আচ্ছা, চাঁদাটা কি দিয়ে গেছেন? বিল কেটে ডিউ লিখে দিয়ে গিয়েছিলাম...’ ‘ওমা, সে তো পরশুদিন সন্টাদা এসে নিয়ে গেছে!’ ‘ও...সন্টাদা নিয়ে গেছে..। আচ্ছা।’— এই ভাবে কথাটা হঠাৎই যেন শেষ হয়ে যেত। কিন্তু ওই যে দুটো মাত্র কথা, দু’বার হঠাৎ চোখে-চোখে তাকানো— সেই আনন্দেই হয়তো পাড়ার বাবাইকে ইস্টবেঙ্গলের সার্পোটার জেনেও বিকেলবেলায় জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের একটা গরম শিঙাড়া খাইয়ে দিলাম।
পুজোর চারটে দিন আমাদের অবশ্য অন্য একটা স্থায়ী পোস্ট ছিল। সেটা হল— ভলান্টিয়ার। আমাদের ডিউটি ছিল সকাল-সকাল প্রতিমার সামনে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে, উপস্থিত ভক্তবৃন্দের হাতে গম্ভীর মুখে মুঠো-মুঠো অঞ্জলির ফুল তুলে দেওয়া। সেই ফুল সবার হাতে দেওয়ার পর পুরুতমশাই পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করতেন। সবার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে মাঝেমধ্যে ভোরের ফুটফুটে শিউলির মতো নিষ্পাপ কয়েকটির কিশোরীর হাতও দেখতে পাওয়া যেত । তখন, কোন্ কিশোর-ভলান্টিয়ার তার হাতে সবার আগে অঞ্জলির ফুল তুলে দিতে পারবে, তাই নিয়ে যেন একটা চোরা কম্পিটিশনও হয়ে যেত। কিন্তু সেই কম্পিটিশনের মধ্যে কোনও ঈর্ষা ছিল না। হিংসা ছিল না। ছিল কিছুটা স্নিগ্ধ সারল্য আর কিছুটা অচেনা আকর্ষণ। ফুল দিতে গিয়ে আঙুলে-আঙুল ঠেকে যাওয়ায়, সারা-শরীরে যে বিদ্যুতের ঝলকানি, জানি না আজ, এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর-কিশোরীদের শরীরেও একই রকম শিহরণ জাগায় কি না!
কার্টুন: দেবাশীষ দেব।